কোরআন মহান আল্লাহর পাক কালাম বা পবিত্র বাণী। কোরআন শব্দের অর্থ যা পাঠ করা হয়, পাঠযোগ্য ও বারবার পাঠের উপযুক্ত। কোরআন অর্থ যা নিকটে পৌঁছে দেয় বা নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম। কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য অর্জন করা যায় বলেই এই নামকরণ।
কোরআনে কারিমে অবতীর্ণ প্রথম সুরার প্রথম আয়াতের প্রথম শব্দেই পাঠের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ‘পড়ো, তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা-৯৬ আলাক, আয়াত: ১)।
কোরআন তিলাওয়াত করা মানে আল্লাহর সঙ্গে কথোপকথন করা। ‘দয়াময় আল্লাহ কোরআন শেখানোর নিমিত্তে মানব সৃষ্টি করলেন, তাকে ভাব প্রকাশ শেখালেন।’ – (সুরা-৫৫ রহমান, আয়াত: ১-৪)
কোরআনে কারিমের তেলাওয়াত স্বতন্ত্র ইবাদত হিসেবে গণ্য। এর ফজিলত অনেক বেশি।
তবে কোরআন তেলাওয়াত করাই উম্মতের চূড়ান্ত লক্ষ্য নয় বরং তেলাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার আদেশ-নিষেধগুলোর সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং সে অনুযায়ী আমল করা। কোরআন তেলাওয়াত করে ক্বারি হিসেবে খ্যাতি লাভ করার উদ্দেশ্যে কোরআন তেলাওয়াত করা ঠিক নয়। অনেকে আবার দুনিয়ার স্বার্থ সিদ্ধির লক্ষ্যে কোরআন তেলাওয়াত করে। এ ধরনের তেলাওয়াতে কোনো কল্যাণ নেই। তবে, নিজ জীবনে কোরআন বাস্তবায়নের পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার জন্য তেলাওয়াত করাটা একটা ক্রমধারা।
কোরআন অন্য কোনো বইয়ের মতো নয়। কোরআন পাঠ করতে হয় যথাযথ ভক্তি, শ্রদ্ধা ও আদব সহকারে। কোরআনে কারিম তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে শিষ্টতাপূর্ণ কিছু নিয়ম-কানুন রয়েছে। কুরআন তেলাওয়াতের আদব সমূহ দু’ভাগে ভাগ করা যায়।
ক. বাতেনী বা অপ্রকাশ্য আদব ও
খ. যাহেরী বা প্রকাশ্য আদব।
অপ্রকাশ্য আদব বলতে যা অন্তরের সাথে সংশ্লিষ্ট বাহ্যিকভাবে যা দেখা যায় না। প্রকাশ্য আদব বলতে বুঝায় যা বাস্তবে দেখা যায়। কোরআন তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে বিষয়গুলো অনুসরণ করা জরুরি।
নিম্নে এর আদবগুলো উল্লেখ করা হলো—
বাতেনী বা অপ্রকাশ্য আদব সমূহ
১. নিয়ত শুদ্ধ করে তেলাওয়াত করা
কুরআন তেলাওয়াত ইবাদত। যার ভিত্তি ইখলাছের উপরে প্রতিষ্ঠিত। ইখলাছ বা একনিষ্ঠতা না থাকলে তা বাতিল হবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘অথচ তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি যে, তারা খালেছ অন্তরে একনিষ্ঠভাবে কেবলমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে’ (আল-বায়্যিনাহ ৯৮/৫)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণির মানুষের ওপর আগুনের শাস্তি কঠোর করা হবে বলে জানিয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন ওই ক্বারি, যিনি ইখলাসের সঙ্গে কোরআন তিলাওয়াত করতেন না। [তিরমিজি, হাদিস : ২৩৮২; সহিহ ইবন হিব্বান, হাদিস : ৪০৮]
মূলতঃ আমল বিশুদ্ধ ও কবুল হয় আমলকারীর নিয়তের উপরে। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয়ই কর্মফল নিয়তের উপরে নির্ভরশীল। প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য তাই হবে, যার সে নিয়ত করবে’।[বুখারী হা/১; মুসলিম হা/১৯০৮; মিশকাত হা/১]
২. আল্লাহর কালামের যথাযোগ্য সম্মান করা
তেলাওয়াতকারী ও শ্রোতা উভয়ের চিন্তা করা উচিত যে, এটা আল্লাহর বাণী। যা জিব্রীল (আঃ)-এর মাধ্যমে রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে নাযিল করা হয়েছে। অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট থেকে ছাহাবায়ে কেরাম শিখেছেন। যখন মানুষ একে আল্লাহর কালাম হিসাবে মনে মনে ভাববে তখন তার অন্তর ভীত হবে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সন্ত্রস্ত হবে। আর তার দেহ-মনে আল্লাহর ভয়, তাঁর সম্মান ও মহত্ত্ব প্রভাব বিস্তার করবে।
৩. মনোযোগ সহকারে তেলাওয়াত করা
কুরআন তেলাওয়াতকালে মন থেকে অন্য সকল চিন্তা দূরে রাখতে হবে। উদাসীনতা পরিহার করে তেলাওয়াত করতে হবে। ক্বারীকে চিন্তা করতে হবে যে, সে তার প্রতিপালকের সামনে আছে এবং তাঁর বাণী তেলাওয়াতের মাধ্যমে তাঁর সাথে কথা বলছে। আল্লাহর কিতাব তেলাওয়াতের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য হাছিল করার চেষ্টা করবে। এতে তার মধ্যে একাগ্রতা ও নিবিষ্টতা বৃদ্ধি পাবে।
জুনদুব ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত ইবাদত মনের চাহিদার অনুকূল হয় ততক্ষণ তিলাওয়াত করতে থাক এবং (তাতে) মনোসংযোগে ব্যাঘাত ঘটলে পড়া ত্যাগ কর’।[বুখারী হা/৫০৬০-৬১; ছহীহুল জামে‘ হা/১১৬৬]
৪. আয়াত অনুধাবনের চেষ্টা করা
তেলাওয়াতকৃত আয়াতের অর্থ ও মর্ম অনুধাবনের চেষ্টা করা উচিত। কেননা এসব আল্লাহর নির্দেশ। যার অর্থ বুঝে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করা যরূরী। আর তেলাওয়াকারীকে চিন্তা করতে হবে যে, আল্লাহ এ কুরআনে বান্দাকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন বিষয়ে আদেশ-নিষেধ করেছেন। সেজন্য আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে যথাযথভাবে বুঝে তা প্রতিপালন করা আবশ্যক। আর আদেশ-নিষেধ অনুধাবন করা কুরআন তেলাওয়াতের অন্যতম উদ্দেশ্য।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘এটি এক বরকতমন্ডিত কিতাব, যা আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি। যাতে লোকেরা এর আয়াত সমূহ অনুধাবন করে এবং জ্ঞানীরা উপদেশ গ্রহণ করে’ [ছোয়াদ ৩৮/২৯]।
তিনি আরো বলেন, ‘তবে কি তারা কুরআন গবেষণা করে না? নাকি তাদের হৃদয়গুলি তালাবদ্ধ’? (মুহাম্মাদ ৪৭/২৪)।
৫. আয়াতের সাথে প্রভাবিত হওয়া
প্রত্যেকটি আয়াতের প্রেক্ষাপট ও সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি নিয়ে চিন্তা করা প্রয়োজন। সেই সাথে আল্লাহ গুণাবলী ও নামসমূহ এবং তাঁর কার্যাবলী সম্পর্কে গবেষণা করলে তাঁর মহত্ত্ব অবহিত হওয়া যাবে। অনুরূপভাবে নবী-রাসূলগণের ঘটনাবলী সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা যে, কিভাবে তাঁদেরকে মিথ্যাপ্রতিপন্ন করা হয়েছিল, তাঁদেরকে কষ্ট দেওয়া হয়েছিল, মুত্তাক্বীদের কি হয়েছিল। আর এসব থেকে উপদেশ গ্রহণ করা। নবী-রাসূলগণকে মিথ্যাপ্রতিপন্নকারী ও আল্লাহর অবাধ্যদেরকে কিভাবে দুনিয়াতে ধ্বংস করা হয়েছিল এবং পরকালে তাদের জন্য কি শাস্তি রয়েছে, সে বিষয়ে চিন্তা করা।
প্রকাশ্য আদব সমূহ
১. পবিত্রতা অর্জন করা
পবিত্র অবস্থায় তথা ওযূ অবস্থায় কুরআন তেলাওয়াত করা উত্তম। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘ওযূ ব্যতীত আমি আল্লাহর নাম নেয়া অপছন্দ করি অথবা তিনি বললেন, পবিত্রাবস্থায় ব্যতীত’।[আবূদাঊদ হা/১৭; নাসাঈ হা/৩৮; মিশকাত হা/৪৬৭; ছহীহাহ হা/৮৩৪]
আর কুরআন তেলাওয়াত যিকরের অন্তর্ভুক্ত। তবে ওযূ ছাড়াও কুরআন তেলাওয়াত করা যাবে। আয়েশা (রাঃ) রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সর্বাবস্থায় আল্লাহর যিকর করতেন’।[মুসলিম হা/৩৭৩; আবূদাঊদ হা/১৮; তিরমিযী হা/৩৩৮৪; ছহীহাহ হা/৪০৬]
তাই ওযূ ছাড়াও তেলাওয়াত করা যাবে। কিন্তু ওযূ অবস্থায় তেলাওয়াত করা উত্তম।
২. মিসওয়াক করা
তেলাওয়াতের পূর্বে মিসওয়াক করে মুখ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমাদের মুখ হল কুরআনের রাস্তা। অতএব তোমরা মিসওয়াক করে তা পবিত্র ও সুগন্ধযুক্ত করো’।[ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৯১]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, আলী (রাঃ) বলেন, ‘আমাদেরকে মিসওয়াক করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, নিশ্চয়ই বান্দা যখন ছালাতে দাঁড়ায়, তখন একজন ফেরেশতা এসে তার পিছনে দাঁড়িয়ে কুরআন তেলাওয়াত শুনতে থাকেন এবং নিকটবর্তী হন। এভাবে তিনি শুনতে থাকেন এবং নিকটবর্তী হ’তে থাকেন। এমনকি তিনি তাঁর মুখ মুছল্লীর মুখের উপরে রাখেন। অতঃপর যখনই সে কোন আয়াত তেলাওয়াত করে তখন তা ফেরেশতার পেটে চলে যায়’।[বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/১৯৩৭; ছহীহাহ হা/১২১৩]
অন্যত্র এসেছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘অতএব তোমরা কুরআনের জন্য তোমাদের মুখকে পবিত্র কর’।[ছহীহাহ হা/১২১৩; ছহীহ আত-তারগীব হা/২১৫]
৩. ক্বিবলামুখী হওয়া
তেলাওয়াতকারীর জন্য মুস্তাহাব হচ্ছে ছালাতের বাইরে কিবলামুখী হওয়া। শিক্ষকের সামনে আদব সহকারে বসার ন্যায় বিনম্র হয়ে বসে তেলাওয়াত করা উত্তম। তবে দাঁড়িয়ে, বসে বা কাত হয়ে কুরআন তেলাওয়াত করলেও তা জায়েয হবে।
যেমন আল্লাহ বলেন، ‘যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আসমান ও যমীনের সৃষ্টি বিষয়ে চিন্তা-গবেষণা করে এবং বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি এগুলিকে অনর্থক সৃষ্টি করনি। মহা পবিত্র তুমি। অতএব তুমি আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচাও’ (আল ইমরান ৩/১৯১)!
আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘নবী করীম (ছাঃ) আমার কোলে হেলান দিয়ে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। আর তখন আমি হায়েয অবস্থায় ছিলাম’।[মুসলিম হা/৩৭৩; আবূদাঊদ হা/১৮; তিরমিযী হা/৩৩৮৪; ছহীহাহ হা/৪০৬]
৪. তেলাওয়াতের শুরুতে আঊযুবিল্লাহ পাঠ করা
তিলাওয়াতের শুরুতে আউজুবিল্লাহ পড়া। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “সুতরাং যখন তুমি কোরআন পড়বে, তখন আল্লাহর কাছে বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় চাও।” [সুরা : নাহল, আয়াত : ৯৮]
এজন্য কোন বিদ্বান ‘আঊযুবিল্লাহ’ পাঠ করাকে ওয়াজিব এবং জমহূর বিদ্বান মুস্তাহাব বলেছেন।
৫. তেলাওয়াতের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা
তেলাওয়াতের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা সুন্নাত। শায়খ ছালেহ আল-ওছায়মীন বলেন, “ছালাতে ছানা বা দো‘আয়ে ইস্তেফতাহ পড়া, বিসমিল্লাহ ও আঊযুবিল্লাহ বলা এবং আমীন বলা সুন্নাত।”[শরহুল মুমতে‘ ৩/৩৩০ পৃঃ] সুতরাং বিসমিল্লাহ বলা ছালাতের মধ্যে যখন ওয়াজিব নয়, সুন্নাত, তখন তা ছালাতের বাইরেও সুন্নাত, ওয়াজিব নয়।
তিলাওয়াতকারীর উচিত সুরা তাওবা ছাড়া সব সুরার শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়া। রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে প্রমাণিত যে তিনি এক সুরা শেষ করে বিসমিল্লাহ বলে আরেক সুরা শুরু করতেন। শুধু সুরা আনফাল শেষ করে সুরা তাওবা শুরু করার সময় বিসমিল্লাহ পড়তেন না।
শায়খ বিন বায (রহঃ) বলেন, সূরা ফাতিহা অথবা অন্য সূরা তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে বিসমিল্লাহ পড়া ছালাতের ভিতরে ও বাইরে সুন্নাত, ওয়াজিব নয়। এটাই সঠিক কথা।[রেফারেন্স]
অতএব যদি কেউ তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে বিসমিল্লাহ ছেড়ে দেয়, তবুও তার তেলাওয়াত সিদ্ধ হবে। কিন্তু সুন্নাত পরিত্যাগ করা হবে। এজন্য তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে বিসমিল্লাহ পড়াকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
৬. গুরুত্বপূর্ণ অর্থবহ আয়াতের পুনরাবৃত্তি
গুরুত্বপূর্ণ আয়াতের অর্থ ও মর্ম অনুধাবনের জন্য বারবার একই আয়াত তেলাওয়াত করা যায়। আবূ যার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “একদা নবী করীম (ছাঃ) ছালাতে দাঁড়িয়ে ভোর হওয়া পর্যন্ত একটি আয়াত বারবার তেলাওয়াত করতে থাকেন।” (আয়াতের অর্থঃ “আপনি যদি তাদের শাস্তি দেন তবে তারা তো আপনারই বান্দা। আর আপনি যদি তাদের ক্ষমা করেন তবে আপনি তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়”) [মায়েদা ৫/১১৮, ইবনু মাজাহ হা/১৩৫০; নাসাঈ হা/১০১০; মিশকাত হা/১২০৫, সনদ ছহীহ]
৭. বিনম্রভাবে তেলাওয়াত করা
কোরআন তিলাওয়াতের আরেকটি আদব হলো তিলাওয়াতের সময় ক্রন্দন করা। আল্লাহ তাআলা তিলাওয়াতের সময় ক্রন্দনরতদের প্রশংসা করে বলেন, ‘আর তারা কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়ে এবং এটা তাদের বিনয় বৃদ্ধি করে।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ১০৯)
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) আমাকে বলেছেন, আমাকে তুমি তিলাওয়াত করে শোনাও। বললাম, আমি আপনাকে তিলাওয়াত শোনাব, অথচ আপনার ওপরই এটি অবতীর্ণ হয়েছে? তিনি বলেন, আমি অন্যের তিলাওয়াত শুনতে পছন্দ করি। অতঃপর আমি তাঁকে সুরা নিসা পড়ে শোনাতে লাগলাম। যখন আমি সুরা নিসার ৪১ নম্বর আয়াত তিলাওয়াত করলাম, তিনি বললেন, ব্যস, যথেষ্ট হয়েছে। আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখলাম তাঁর চোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে। [বুখারি, হাদিস : ৫০৫০; মুসলিম, হাদিস : ১৯০৩]
আয়াতটি হলো, ‘যখন আমি প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করব এবং তোমাকে উপস্থিত করব তাদের ওপর সাক্ষীরূপে, তখন কী অবস্থা হবে?’
কাসিম (রহ.) একবার আয়েশা (রা.)-এর কাছ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তিনি দেখেন, আয়েশা (রা.) একটি আয়াত বারবার আবৃত্তি করছেন আর কেঁদে কেঁদে দোয়া করছেন। আয়াতটি হলো, ‘অতঃপর আল্লাহ আমাদের প্রতি দয়া করেছেন এবং আগুনের আজাব থেকে আমাদের রক্ষা করেছেন।’ (সুরা : তুর, আয়াত : ২৭)
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) যখন এ আয়াত তিলাওয়াত করেন, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেন। আয়াতটি হলো, ‘আর মৃত্যুর যন্ত্রণা অবশ্যই আসবে, যা থেকে তুমি পলায়ন করতে চাইতে।’ (সুরা : ক্বফ, আয়াত : ১৯)
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) যখন এ আয়াতটি পড়তেন, তখনই তিনি কান্নাকাটি করতেন। আয়াতটি হলো, ‘…আর তোমাদের মনে যা আছে, তা যদি তোমরা প্রকাশ করো অথবা গোপন করো, আল্লাহ সে বিষয়ে তোমাদের হিসাব নেবেন…।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৮৪)
মূল কথা হলো, কোরআন তিলাওয়াতের সময় কান্নাকাটি করা এবং চোখে পানি আসা ঈমানের আলামত। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কোরআনের পাঠকদের মধ্যে ওই ব্যক্তির কণ্ঠ সর্বোত্তম, যার তিলাওয়াত কেউ শুনলে মনে হয় যে সে কাঁদছে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৩৩৯)
মুত্বাররিফ ইবনু আব্দুল্লাহ বিন শিখখীর (রহঃ) স্বীয় পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট আসলাম। তখন তিনি ছালাত আদায় করছিলেন এবং তাঁর ভিতর থেকে টগবগে আওয়াজ হচ্ছিল যেমন ডেগের ফুটন্ত পানির টগবগ আওয়াজ হয়। অর্থাৎ তিনি কান্নাকাটি করছিলেন। অন্য বর্ণনায় আছে, তিনি বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে ছালাত আদায় করতে দেখেছি। এমতাবস্থায় তাঁর বুকের মধ্যে চাক্কির আওয়াজের ন্যায় কান্নার আওয়াজ হ’তে থাকত।[আবূদাঊদ হা/৯০৪; নাসাঈ হা/১২১৪; ছহীহ আত-তারগীব হা/৫৪৪; মিশকাত হা/১০০০]
৮. রহমতের আয়াত আসলে তা চাওয়া এবং আযাবের আয়াত আসলে তা হতে পানাহ চাওয়া
কুরআন তেলাওয়াতকালে রহমতের আয়াত আসলে আল্লাহর নিকটে তাঁর রহমত প্রার্থনা করা এবং আযাবের আয়াত আসলে তা থেকে আল্লাহর নিকটে আশ্রয় প্রার্থনা করা কর্তব্য।
হুযায়ফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি এক রাত্রে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে ছালাত আদায় করলাম। তিনি সূরা বাক্বারাহ শুরু করলেন, আমি মনে মনে বললাম যে, হয়তো তিনি একশত আয়াত পরিমাণ তেলাওয়াত করে রুকূ করবেন। কিন্তু তিনি তেলাওয়াত চালিয়েই যেতে থাকলেন, আমি মনে মনে বললাম, হয়তো তিনি দু’শত আয়াত পরিমাণ তেলাওয়াত করে রুকুতে যাবেন, কিন্তু তিনি তেলাওয়াত চালিয়েই যেতে থাকলেন। আমি মনে মনে বললাম, হয়তো তিনি পূর্ণ সূরা এক রাক‘আতেই তেলাওয়াত করে ফেলবেন। কিন্তু তিনি তেলাওয়াত চালিয়ে যেতে থাকলেন এবং সূরা নিসা শুরু করে তাও তেলাওয়াত করে ফেললেন। তারপর সূরা আলে ইমরানও শুরু করে তাও তেলাওয়াত করে ফেললেন। তিনি ধীরে ধীরে তেলাওয়াত করতেন। যদি তিনি এমন কোন আয়াত তেলাওয়াত করে ফেলতেন যাতে কোন তাসবীহ রয়েছে তবে তাসবীহ পাঠ করতেন, যদি কোন যাঞ্ছা করার আয়াত তেলাওয়াত করতেন তখন যাঞ্ছা করতেন। যদি কোন বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনার আয়াত তেলাওয়াত করতেন, তখন আশ্রয় প্রার্থনা করতেন।[মুসলিম হা/৭৭২; আবূদাঊদ হা/৮১৫; নাসাঈ হা/১৬৬৪]
৯. তেলাওয়াতে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী বস্ত্ত দূরে রাখা
কুরআন তেলাওয়াতের সময় তিলওয়াতে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী যাবতীয় কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকা মুস্তাহাব। যেমন হাসাহাসি, খেলাধূলা, হাতে অনর্থক কাজ করা, বিনা প্রয়োজনে এদিক-সেদিক তাকানো, মোবাইল টেপা, অন্যের সাথে অনর্থক কথা বলা, তিলওয়াতের মাঝে লোকের সাথে অপ্রয়োজনীয় কথা বলে তিলওয়াত বন্ধ করে দেওয়া এবং অযথা বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তা করা ইত্যাদি।
১০. হাই তোলার সময় তিলওয়াত বন্ধ রাখা
হাই তোলার সময়ে তেলাওয়াত বন্ধ রাখা কর্তব্য। মুজাহিদ (রহঃ) বলেন, ‘যখন তুমি হাই তোল তেলাওয়াত অবস্থায়, তখন তুমি ক্বিরাআত থেকে বিরত থাক কুরআনের সম্মানে, যতক্ষণ না তোমার হাই চলে যায়’।[মুহাম্মাদ ছাফা শায়খ ইবরাহীম হাক্বী, উলূমুল কুরআন মিন খিলালে মুক্বাদ্দামাতিত তাফাসীর, ২য় খন্ড, (বৈরূত : মুআসসাতুর রিসালাহ, ১ম প্রকাশ, ১৪২৫হিঃ/২০০৪খ্রিঃ), পৃঃ ১৯৭]
নাফে‘ (রহঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘ইবনু ওমর (রাঃ) যখন কুরআন তেলাওয়াত করতেন তখন কুরআন তেলাওয়াত হ’তে অবসর না হয়ে কোন কথা বলতেন না’।[বুখারী হা/৪৫২৬, ৪৫২৭]
১১. সুন্দর কণ্ঠে তেলাওয়াত করা
সুন্দর করে মনের মাধুরী মিশিয়ে কোরআন পড়া। বারা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে এশার নামাজে সুরা ত্বিন পড়তে শুনেছি। আমি তাঁর চেয়ে সুন্দর কণ্ঠে আর কাউকে তিলাওয়াত করতে শুনিনি।’ [বুখারি, হাদিস : ৭৫৪৬; মুসলিম, হাদিস : ১০৬৭]
সুরসহকারে কোরআন তিলাওয়াত করা সুন্দর করে কোরআন তিলাওয়াতের অংশ। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘সে আমার উম্মত নয়, যে সুর-সহযোগে কোরআন পড়ে না।’ [বুখারি, হাদিস : ৭৫২৭; আবু দাউদ, হাদিস : ১৪৭১]
আল্লাহ কুরআন তেলাওয়াত শুনে থাকেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা কোন বিষয়ের প্রতি এরূপ কান লাগিয়ে শুনেন না যেরূপ তিনি নবীর সুমধুর তেলাওয়াত শুনেন’।[বুখারী হা/৫০২৪; মুসলিম হা/৭৯২; মিশকাত হা/২১৯২]
এজন্য সুন্দর কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করতে রাসূল (ছাঃ) নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা সুললিত কণ্ঠে কুরআনকে সুসজ্জিত করে পাঠ কর’।[আবূদাঊদ হা/১৪৬৮; ইবনু মাজাহ হা/১৩৪২; ছহীহাহ হা/৭৭২; মিশকাত হা/২১৯৯]
তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা তোমাদের কণ্ঠস্বর দ্বারা কুরআনকে সৌন্দর্যমন্ডিত কর। কারণ সুমিষ্ট স্বর কুরআনের সৌন্দর্য বাড়ায়’।[দারিমী হা/৩৫৪৪; ছহীহাহ হা/৭৭১; ছহীহুল জামে‘ হা/৩১৪৫]
সুন্দর আওয়াজে তেলাওয়াত করা কুরআনের সৌন্দর্য। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘সুন্দর আওয়াজ (কণ্ঠস্বর) কুরআনের সৌন্দর্য’।[ছহীহুল জামে‘ হা/৩১৪৪; ছহীহাহ হা/১৮১৫]
অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘মানুষের মধ্যে সুকণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াতকারী সেই ব্যক্তি যার তেলাওয়াত শুনে তোমাদের ধারণা হয় যে, সে আল্লাহর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত’।[ইবনু মাজাহ হা/১৩৩৯; ছহীহুল জামে‘ হা/২২০২; ছহীহ আত-তারগীব হা/১৪৫০]
উল্লেখ্য, গানের সুরে ও বাজনার তালে তালে কুরআন তেলাওয়াত করা যাবে না।
১২. তারতীল ও তাজবীদসহ তিলওয়াত করা
ধীরে-সুস্থে কুরআন তিলওয়াত করা। আল্লাহ বলেন, ‘আর কুরআন তেলাওয়াত করুন ধীরে-সুস্থে সুন্দরভাবে’ [মুযযাম্মিল ৭৩/৪]।
ক্বতাদাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আনাস (রাঃ)-কে নবী করীম (ছাঃ)-এর ক্বিরাআত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’ল যে, নবী করীম (ছাঃ)-এর ক্বিরাআত কেমন ছিল? উত্তরে তিনি বললেন, নবী করীম (ছাঃ)-এর ক্বিরাআত দীর্ঘ ছিল। এরপর তিনি বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রহীম তেলাওয়াত করলেন এবং বললেন, নবী করীম (ছাঃ) বিসমিল্লাহ আর-রহমান, আর-রহীম পড়ার সময় দীর্ঘায়িত করতেন’।[বুখারী হা/৫০৪৫-৪৬; মিশকাত হা/২১৯১]
১৩. বড় অপবিত্রতায় কুরআন স্পর্শ না করা
গোসল ফরয হওয়া, হায়েয, নেফাস ইত্যাদি অবস্থায় কুরআন স্পর্শ না করা। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘পবিত্রগণ ব্যতীত কেউ একে স্পর্শ করেনি’ [ওয়াকি‘আহ ৫৬/৭৯]। এখানে পবিত্রগণ বলতে ফেরেশতাদের বুঝানো হয়েছে।
রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘পবিত্র লোক ছাড়া যেন কোন ব্যক্তি কুরআন স্পর্শ না করে’।[মুওয়াত্ত্বা মালিক হ/৪৬৮; ছহীহুল জামি‘ হা/৭৭৮০; মিশকাত হা/৪৬৫] এখানে পবিত্র বলতে জুনুবী বা যার উপরে গোসল ফরয এমন ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে।
আর ছোট অপবিত্রতা বা ওযূ ভঙ্গ হয়ে গেলে কুরআন স্পর্শ করা যাবে এবং দেখে তেলাওয়াত করা যাবে।[তুহফাতুল আহওয়াযী ১/৩৮৭; নায়লুল আওত্বার ১/২৫৯] তবে ওযূ করে তেলাওয়াত করা উত্তম।
উল্লেখ্য যে, ফরয গোসলের নাপাকীতে কুরআন আদৌ স্পর্শ করা যাবে না। তবে মুখস্থ পড়া যাবে। তাছাড়া কুরআন মুদ্রণ, বাইন্ডিং, বহন ইত্যাদি যরূরী কাজে নিয়োজিত মুসলিম কর্মচারীরা ওযূ ব্যতীত এটি স্পর্শ করতে পারবে। কিন্তু কাফের-মুশরিকরা তা স্পর্শ করতে পারবে না।
১৪. তন্দ্রা অবস্থায় তেলাওয়াত না করা
রাতে ঘুম পেলে বা ঝিমুনি এলে তিলাওয়াত থেকে বিরত থাকা। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, “যখন তোমাদের কেউ রাতে নামাজ পড়ে, ফলে তার জিহ্বায় কোরআন এমনভাবে জড়িয়ে আসে যে সে কী পড়ছে তা টের পায় না, তাহলে সে যেন শুয়ে পড়ে।” [মুসলিম, হাদিস : ৭৮৭; আবূ দাঊদ ১৩১১, মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৮২১৪]
অর্থাৎ তার উচিত এমতাবস্থায় নামাজ না পড়ে বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়া, যাতে তার মুখে কোরআন ও অন্য কোনো শব্দের মিশ্রণ না ঘটে এবং কোরআনের আয়াত এলোমেলো হয়ে না যায়।
১৫. কুরআন অনুযায়ী আমল করা
কুরআন অনুযায়ী আমল করা যরূরী। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা এই কিতাবের দ্বারা কতক লোককে উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন এবং কতককে অবনমিত করেন’।[মুসলিম হা/৮১৭; ইবনু মাজাহ হা/২১৮; মিশকাত হা/২১১৫]
অর্থাৎ যারা এর প্রতি পূর্ণাঙ্গ ঈমান আনয়ন করতঃ তাকে সম্মান করে এবং সে অনুযায়ী আমল করে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।[26] কেউ বলেন, যারা ইলম অনুযায়ী আমল করেন তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং যারা তা করেন না, তাদেরকে অবনমিত করেন।[মির‘আত ৪/১৪৯৭]
রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন, ‘কুরআন হ’ল তোমার পক্ষে অথবা বিপক্ষের প্রমাণ’[মুসলিম হা/২২৩; তিরমিযী হা/৩৫১৭; ইবনু মাজাহ হা/২৮০; মিশকাত হা/২৮১]
এ হাদীছের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী বলেন, যদি তুমি কুরআন তেলাওয়াত কর ও সে অনুযায়ী আমল কর, তাহ’লে তুমি উপকৃত হবে। অন্যথা কুরআন তোমার বিপক্ষে দলীল হবে।[শরহু মুসলিম ৩/১০২]
অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) কুরআন অনুযায়ী আমল না করলে কবরে ক্বিয়ামত অবধি শাস্তি হবে বলে উল্লেখ করেছেন।[বুখারী হা/১৩৮৬, ১০৭৫]
আমল বিহীন ক্বারীর উদাহরণ পেশ করে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘ঐ মুমিন যে কুরআন পাঠ করে এবং সে অনুযায়ী আমল করে, তাঁর দৃষ্টান্ত ঐ লেবুর মত যা খেতে সুস্বাদু এবং গন্ধে চমৎকার। আর ঐ মুমিন যে কুরআন পাঠ করে না; কিন্তু এর অনুসারে আমল করে তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে ঐ খেজুরের মত যা খেতে সুস্বাদু কিন্তু সুগন্ধ নেই। আর মুনাফিক যে কুরআন পাঠ করে তার উদাহরণ হচ্ছে, ঐ রায়হানের মত, যার মন মাতানো খুশবু আছে, অথচ খেতে একেবারে বিস্বাদ। আর ঐ মুনাফিক যে কুরআন পাঠ করে না, তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে ঐ মাকাল ফলের মত, যা খেতে বিস্বাদ এবং গন্ধে দুর্গন্ধময়’।[বুখারী হা/৫০৫৯, ৫০২০]
১৬. তেলাওয়াতের মাধ্যমে অন্যকে বিরক্ত না করা
উচ্চৈঃস্বরে কুরআন তেলাওয়াত করে অন্যকে বিরক্ত করা উচিত নয়। অনেকে অসুস্থ থাকে, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকে, শিক্ষার্থীরা অধ্যয়নে মশগূল থাকে এবং কেউবা ছালাতে বা যিকরে রত থাকে; এমতাবস্থায় উচ্চৈঃস্বরে তেলাওয়াত করে তাদেরকে বিরক্ত করা অদৌ উচিত নয়।
রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘একজনের কুরআন তেলাওয়াতের শব্দ অন্যজনের কানে যেন না পৌঁছে।[আহমাদ হা/১৯০৪৪; মিশকাত হা/৮৫৬; ছহীহাহ হা/১৬০৩; ছহীহুল জামে‘ হা/১৯৫১]
অর্থাৎ ছালাতরত ব্যক্তি, ঘুমন্ত ও অন্য কোন তেলাওয়াতকারীকে যেন উচ্চৈঃস্বরে তেলাওয়াতের মাধ্যমে বিরক্ত করা বা কষ্ট দেওয়া না হয়।[মিরকাত ২/৭০২ পৃঃ]
ইবুন রজব বলেন, মসজিদে ছালাতরত অবস্থায় উচ্চৈঃস্বরে তেলাওয়াতের মাধ্যমে বিরক্ত না করা।[ইবুন রজব হাম্বলী, ফাতহুল বারী, ৩/৩৯৮ পৃঃ]
১৭. রুকূ-সিজদায় তেলাওয়াত না করা
ছালাতের রুকূ‘-সিজদায় কুরআন তেলাওয়াত করা নিষেধ। আবু বকর (রাঃ) বলেন, ‘হে লোকেরা! নবুঅতের কিছুই অবশিষ্ট নেই, তবে মুসলিমরা যে নেক স্বপ্ন দেখবে তা ব্যতীত। তিনি আরো বলেন, আমাকে রুকূ‘ ও সিজদাতে কুরআন পড়তে নিষেধ করা হয়েছে। সুতরাং তোমরা রুকূ‘ অবস্থায় রবের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করো এবং সিজদাতে বেশী করে দো‘আ পড়ার চেষ্টা করো। আশা করা যায়, তোমাদের দো‘আ কবুল হবে’।[মুসলিম হা/৪৭৯; আবূদাঊদ হা/৮৭৬; ইবনু মাজাহ হা/৩৮৯৯]
১৮. ধৈর্য নিয়ে কোরআন তিলাওয়াত করা
কুরআন তেলাওয়াতে পারদর্শী না হ’লে অনেক সময় তেলাওয়াত করতে কষ্ট হয়। এক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করে তেলাওয়াত করলে দ্বিগুণ ছওয়াব পাওয়া যায়।
যিনি অনায়াসে কোরআন পড়তে পারেন না, তিনি আটকে আটকে ধৈর্যসহ পড়বেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “কোরআন পাঠে যে অভিজ্ঞ ব্যক্তি কোরআন তিলাওয়াত করে, সে সম্মানিত রাসুল ও পুণ্যাত্মা ব্যক্তিদের সঙ্গে থাকবে। আর যে ব্যক্তি তোতলাতে তোতলাতে সক্লেশে কোরআন তিলাওয়াত করবে, তার জন্য দ্বিগুণ নেকি লেখা হবে।” [বুখারি, হাদিস : ৪৯৩৭; মুসলিম, হাদিস : ১৮৯৮]
১৯. তিনদিনের কমে কুরআন খতম না করা এবং এর মর্ম নিয়ে চিন্তা করা
কোরআন তিলাওয়াতের আরেকটি আদব হলো এর মর্ম নিয়ে চিন্তা করা। এটিই তিলাওয়াতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আদব। তিলাওয়াতের সময় চিন্তা-গবেষণা করাই এর প্রকৃত সুফল বয়ে আনে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আমি তোমার প্রতি নাজিল করেছি এক বরকতময় কিতাব, যাতে তারা এর আয়াতগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং যাতে বুদ্ধিমানরা উপদেশ গ্রহণ করে।’ [সুরা : সদ, আয়াত : ২৯]
তিনদিনের কম সময়ে কুরআন খতম না করা। কেননা এত অল্প সময়ে কুরআন খতম করলে কুরআন বোঝা সম্ভব নয়। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি কয়দিনে কুরআন খতম করব? তিনি বললেন, এক মাসে। তিনি বললেন, আমি এর চেয়ে অধিক শক্তি রাখি। আবূ মূসার বর্ণনায় রয়েছে অতঃপর আলোচনার মাধ্যমে সময়ের ব্যবধান কমিয়ে অবশেষে বললেন, সাত দিনে খতম করবে। তিনি বললেন, আমি এর চেয়েও বেশী শক্তি রাখি। তিনি বললেন, যে ব্যক্তি তিন দিনের কমে কুরআন খতম করে, সে কুরআনকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না’।[আবূ দাঊদ হা/১৩৯০; তিরমিযী হা/২৯৪৬; ছহীহাহ হা/১৫১৩; মিশকাত হা/২২০১]
জায়েদ বিন সাবেত (রা.)-কে একজন জিজ্ঞেস করলেন, সাত দিনে কোরআন খতম করাকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন? তিনি বলেন, এটা ভালো। অবশ্য আমি এটাকে ১৫ দিনে বা ১০ দিনে খতম করাই পছন্দ করি। আমাকে জিজ্ঞেস করো, তা কেন? তিনি বলেন, আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করছি। জায়েদ বলেন, যাতে আমি তার স্থানে স্থানে চিন্তা করতে পারি এবং থামতে পারি।’ [মুয়াত্তা মালেক, হাদিস : ৪৭২]
২০. সশব্দে কিংবা নীরবে তেলাওয়াত করা
কুরআন সশব্দে ও নীরবে তেলাওয়াত করা যায়। ক্বারীর অবস্থা ও পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী কখনও সরবে ও কখনো নীরবে পড়া উত্তম।
যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘মহান আল্লাহ অন্য কিছু এত মনোযোগ দিয়ে শুনেন না, যেভাবে তিনি নবীর সুমধুর কন্ঠে স্পষ্ট উচ্চারণে কুরআন পাঠ শুনেন’।[মুসলিম হা/৭৯২-৯৩; আবূদাঊদ হা/১৪৭৩; নাসাঈ হা/১০১৭]
অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘উচ্চৈঃস্বরে কুরআন তেলাওয়াতকারী প্রকাশ্যে দানকারীর মতো এবং নিঃশব্দে কুরআন তেলাওয়াতকারী গোপনে দানকারীর মতো’।[আবূদাঊদ হা/১৩৩৩; তিরমিযী ‘ফাযায়িলে কুরআন’ অধ্যায় হা/২৯১৯; নাসাঈ হা/১৬৬২ ‘ক্বিয়ামুল লাইল’ অধ্যায়, ‘স্বরবের উপর নীরবের ফযীলত’ অনুচ্ছেদ; মিশকাত হা/২২০২]
ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, নীরবে তেলাওয়াত লৌকিকতামুক্ত। সুতরাং যে ব্যক্তি লৌকিকতার ভয় করে তার জন্য নীরবে তেলাওয়াত করা উত্তম। আর যদি রিয়ার আশঙ্কা না করে তাহ’লে সরবে তেলাওয়াত করা উত্তম। তবে শর্ত হ’ল অন্য মুছল্লী, ঘুমন্ত ব্যক্তি কিংবা অন্য কাউকে কষ্ট দেওয়া না হয়। অন্যথা নীরবে উত্তম। আর সরবে তেলাওয়াত উত্তম হওয়ার কারণ হ’ল এরূপ আমল সাধারণত অধিক করা হয়, এতে অন্যেরা উপকৃত হয়, শ্রবণ, শিক্ষা, অনুসরণ করা এবং এটা দ্বীনের নিদর্শন হওয়ার কারণে। তাছাড়া এতে ক্বারীর অন্তর জাগ্রত হয়, তার মনোযোগ এর প্রতি নিবদ্ধ হয়, এর প্রতি তার কর্ণ প্রত্যাবর্তিত হয়; এর দ্বারা ক্বারীর ঘুম দূর হয়, তার উদ্যম বৃদ্ধি পায়। সেই সাথে ঘুমন্ত ও উদাসীন ব্যক্তি জাগ্রত, সচেতন ও উৎসাহী হয়। তাই এরূপ নিয়তে সরবে তেলাওয়াত করা উত্তম।[মির‘আত, ৭/২৮৪ পৃঃ]
২১. তেলাওয়াতের সিজদা দেওয়া
তেলাওয়াতের সময় সিজদার আয়াত আসলে সিজদা করা সুন্নাত। এই সিজদা করলে নেকী আছে, না করলে গোনাহ নেই।
এ সম্পর্কে হাদীছে এসেছে, ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন,
‘এক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আজ রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় স্বপ্নে দেখলাম যে, আমি যেন একটি গাছের পিছনে ছালাত আদায় করছি। আমি তেলাওয়াতের সিজদা করলাম এবং গাছটিও আমার সাথে সাথে সিজদা করল। আমি গাছটিকে বলতে শুনলাম ‘হে আল্লাহ! এই সিজদার বিনিময়ে তোমার কাছে আমার জন্য ছওয়াব নির্ধারণ করে রাখ, এর বিনিময়ে আমার একটি গোনাহ দূর কর, এটাকে তোমার কাছে আমার জন্য সঞ্চয় হিসাবে জমা রাখ এবং এটা আমার নিকট হ’তে গ্রহণ করে নাও, যেভাবে তুমি তোমার বান্দা দাঊদ (আঃ)-এর নিকট গ্রহণ করেছিলে’। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সিজদার আয়াত পাঠ করলেন এবং সিজদা করলেন। ইবনু আববাস (রাঃ) আবার বললেন, আমি তাঁকে তখন সেই গাছের দো‘আটির মতো পাঠ করতে শুনলাম, যে সম্পর্কে ইতিপূর্বে লোকটি তাকে জানিয়েছিল’।[41] উল্লেখ্য, এই সিজদায় ওযূ বা ক্বিবলা শর্ত নয়। সিজদা মাত্র একটি হবে। এতে তাশাহ্হুদ নেই, সালামও নেই।[ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৬৪]
২২. দীর্ঘ সময় নিয়ে কুরআন খতম না করা
অধিক সময় নিয়ে কুরআন খতম না করে সাধ্যমত কম সময়ে কুরআন খতম করা উচিত। আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, তাকে রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘তুমি চল্লিশ দিনে কুরআন পাঠ (শেষ) করবে’।[আবূদাঊদ হা/১২৬১; তিরমিযী হা/২৯৪৭; ছহীহাহ হা/১৫১২]
২৩. ক্বিরআতে পারদর্শী না হলে আলেমদের নিকটে পেশ করা
কুরআন তেলাওয়াতে পারদর্শী না হ’লে যারা তেলাওয়াতে দক্ষ তাদের নিকটে পেশ করা এবং ভুল-ত্রুটি থাকলে সংশোধন করে নেওয়া কর্তব্য। যেমন রাসূল (ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামকে বিশেষ ব্যক্তিদের নিকট থেকে কুরআন শেখার নির্দেশ দেন।
মাসরূক (রহ.) হ’তে বর্ণিত, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ)-এর মজলিসে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর আলোচনা হচ্ছিল। তখন তিনি বললেন, তিনি সে ব্যক্তি যাঁকে নবী করীম (ছাঃ)-এর বক্তব্য শুনার পর হ’তে আমি খুব ভালবাসি। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, কুরআন শিক্ষা কর চারজনের নিকট থেকে, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (সর্ব প্রথম তিনি এ নামটি বললেন), সালিম আবূ হুযাইফার আযাদকৃত গোলাম, মু‘আয ইবনু জাবাল ও উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ)।[বুখারী হা/৩৮০৮,৩৭৫৮, ৪৯৯৯; মুসলিম হা/২৪৬৪] কারণ তারা রাসূলের যুগে কুরআন সংরক্ষণ করেছিলেন।[বুখারী হা/৩৮১০, ৫০০৩; মুসলিম হা/২৪৬৫]
২৪. আয়াতের মাঝে তেলাওয়াত বন্ধ করে না দেওয়া
কুরআন তেলাওয়াতকালে আয়াতের মাঝে তেলাওয়াত বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। কারণ আল্লাহর কালামের উপরে অন্য কিছুকে প্রাধান্য দেওয়া যাবে না।
নাফে‘ (রহঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘ইবনু ওমর (রাঃ) যখন কুরআন তিলাওয়াত করতেন তখন কুরআন তেলাওয়াত হ’তে অবসর না হয়ে কোন কথা বলতেন না’।[বুখারী হা/৪৫২৬, ৪৫২৭]
২৫. কুরআন নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত না হওয়া
কুরআন নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হওয়া সমীচীন নয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘কুরআন নিয়ে বিতর্ক করা কুফরী’।[ছহীহুল জামে‘ হা/৩১০৬]
তিনি আরো বলেন, ‘পূর্ববর্তী সকল উম্মতই ধ্বংস হয়েছে যখনই তারা এ ধরনের কাজে জড়িত হয়েছে। তারা কুরআন নিয়ে একে অপরের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছে। এতে হালাল করা হয়েছে, তাকে হালাল গণ্য কর এবং এতে যা হারাম করা হয়েছে তাকে হারাম গণ্য কর। আর যা সন্দেহপূর্ণ বা দ্ব্যর্থবোধক তার প্রতি ঈমান রাখ’।[ছহীহুল জামে‘ হা/১৩২২]
২৬. ফজিলতপূর্ণ সুরাগুলো ভালোভাবে শিক্ষা করা এবং সেগুলো বেশি বেশি তিলাওয়াত করা
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ কি রাত্রিকালে কোরআনের এক-তৃতীয়াংশ তিলাওয়াতে অক্ষম? তারা বলল, কোরআনের এক-তৃতীয়াংশ কিভাবে পড়া যাবে! তিনি বলেন, ‘সুরা ইখলাস কোরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমতুল্য।’ [মুসলিম, হাদিস : ১৯২২; বুখারি, হাদিস : ৫০১৫]
অতএব, কুরআন তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে উপরোক্ত আদব বা শিষ্টাচার সমূহ মেনে চলা যরূরী। এর ফলে অশেষ ছওয়াব হাছিল হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে এবং কুরআন তেলাওয়াত সহ ইসলামী আদব বা শিষ্টাচার মেনে চলার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!
ইসলামি স্কলারদের অভিমত হচ্ছে, কোরআন নিয়মিত তেলাওয়াত করা। ধীরে ধীরে তেলাওয়াতের পরিমাণ বাড়াতে থাকা। নিজে নির্ধারণ করে নেওয়া, প্রতিদিন কতটুকু করে তেলাওয়াত করবে সে বিষয়ে। আল্লাহতায়ালা সবাইকে নিয়ম করে, যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে প্রতিদিন কোরআন তেলাওয়াত করার তওফিক দান করুন।
আমিন।